ছোট শহরের চেলেবেলা
চ্যাপ্টার ১: ভূতের গল্পে হাসির ছোঁয়া
কালীপুজোর অন্ধকার কাটাতে আমরা আলোর রোশনাই এ ঘর সাজিয়ে তুলি। আলো দিয়ে অন্ধকারের সাথে সাথে ভূতকেও ভাগাই কারণ আমরা মানি যে কালীপুজোর আগের দিন ভূত চতুর্দশীতে বংশের পূর্বজরা নাকি এঁকে এঁকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন ধরাতলে। সচক্ষে প্রতক্ষ না করলেও আমাদের বাপ ঠাকুর্দার কাছ থেকে বেশির ভাগ শোনা কারণ ওনাদের আমলেই দৌরাত্ম ছিল যে অনেক বেশি! সেই সময়ে বয়স্করা কচিকাঁচাদের ভূতের গল্পে মজিয়ে রাখবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক।
আমার বাবা বেশ মজা করে ভূতের গল্প বলতে পারতেন আর সেজন্যেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন ছোটদের মাঝে। হয়তো ভাবতে বসবেন ভূতের গল্প আর মজা দুটো কী করে হয় কিন্তু সেটাই ছিল বাবার জনপ্রিয়তার কারণ।
হরেক রকমের ভূতের সাথে অনায়াস দক্ষতায় হাস্যরস যোগ করে দিতেন। ছিল ঝুলিতে যেমন ব্রহ্মদত্তি, শাকচুন্নি তেমনি হাস্যরস জোগাতে কিঙ্কেবুড়ো (একটি কাল্পনিক চরিত্র যেটি এক বয়স্ক ব্রাহ্মণ রূপী ভূত বেলগাছের মগডালে অধিষ্ঠান করতেন) এর মতন কাল্পনিক চরিত্রও অনায়াসে হাজির করে দিতে পারতেন।
আবার কল্পনাশক্তি দিয়ে কিঙ্কেবুড়ো রূপী ভূতের টিকিটাতে একটা আস্ত বেল বেঁধে দিয়ে ছুটিয়ে মারতেন। ভূতের মাথায় বেলের আঘাতে বড়োসড়ো আলু না বেরোনো অবধি ভূত ও ছুটছে আর বাবাও ছুটছে।
সবাই চেষ্টা করেও ওই ছোটাছুটির পরের ঘটনা আর জানতে পারতো না। গল্পটা না হলে শেষ হয়ে যাবে তো!
চ্যাপ্টার ২: বাঁশবনের বিভীষিকা
এমনি ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা সময়ের ভূতের গপ্পো। কিছুটা রূপকথা দিয়ে গড়া যেমনটি ঠাকুরমার ঝুলির থেকে নেয়া তেমনি ছিল আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা কিছু ঘটনা।
এমন একটি ঘটনা নিজস্ব অনুভব থেকে বলি।
এক বিজয়া দশমীর রাতে প্রতিবারের মতো আমাদের বাড়ির প্রথা অনুযায়ী ঠাকুর বিসর্জনের পর পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছি বাড়ির ছোট বড় সবাই মিলে বিজয়া করতে।
মনে তখন লাড্ডু ফুটছে কখন রকমারি মিষ্টির স্বাদ পাবো যেগুলো ওনারা প্রাপ্য হিসেবে অন্য পুজোবাড়ি থেকে পেয়ে থাকেন। ওনাদের বাড়ির রাস্তা বেশ নির্জন প্রায় দু কিলোমিটার দূরে; কিছু ঝোপঝাড়, কয়েকটা পুকুর আর একটা মস্ত বড়ো বাঁশঝাড় রাস্তায় পড়ে।
সেবার বৃষ্টি বেশি হয়েছিল বলে পুকুর গুলো কানায় কানায় ভরা এমনকি রাস্তাতেও জল এসে গেছে। আমরা দুটো গ্রুপ ভাগ হয়ে চলেছি যার মধ্যে আমি ছিলাম শেষটায়।আমাদের গ্রুপে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ টর্চ এর আলোয় রাস্তা দেখিয়ে চলেছে। দূর থেকে শিয়ালের ডাক ক্রমশ কাছে আসছে।
আমি আর এক খুড়তুতো ভাই নিজের মনে গল্প করতে করতে কখন যে অজান্তেই দল থেকে পিছিয়ে পড়েছি বুঝলাম যখন বাঁশবাগানের কাছে আসতেই একটা শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক ছেড়ে তীব্রগতিতে পলায়ন দেখে। আর ঠিক সেই সময়েই আমাদের ঠিক সামনেই বাঁশের ঝাড় থেকে আস্ত একটা বাঁশ সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়লো।ব্যাপারটা অনুধাবন করার আগেই আমাদের মুখ দিয়ে বাবাগো বলে আওয়াজ বেরিয়ে এলো।
সম্বিৎ ফিরতেই আবিষ্কার করলাম একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ির আলো।দে ছুট, দে ছুট একেবারে বাড়িতে পৌছিয়েই গেছি প্রায় দেখি বাকিরা আমাদের খোঁজে লণ্ঠন হাতে বেরোনোর উপক্রম করছেন।
বকুনি খাবার ভয়ে ঘটনাটা আর বড়োদের জানানো হয়নি।
গাছেদের ছায়ায় আমার ছেলেবেলা
আমার ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতার উপকণ্ঠে এক ছোট শহরে। এককালে যেথা দিয়ে আদি গঙ্গা বইত, এখন সেখানে কেবল ছোট ছোট পুকুরের জাল। সেই পুকুরগুলোর চারপাশে ছিল ঘন বাঁশবাগান, আর মাঝে দিয়ে যেত এক সরু পথ। বর্ষার রাতে, যখন ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক আর ব্যাঙের গলা মিলে এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি করত, তখন সেই পথ দিয়ে একা হাঁটার সাহস ক’জনেরই বা ছিল! অনেক সাহসী লোককেও দেখেছি ‘রাম নাম’ বলতে বলতে হাঁটতে।
সেই ছেলেবেলায় ভূতের গল্প ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। মা একটা ছড়া শিখিয়েছিলেন—
“ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি,
রাম-লক্ষণ সাথে আছে, ভয়টা আমার কি!”
এই ছড়ার জোরেই যেন আমাদের সাহস গেঁথে গিয়েছিল হৃদয়ে। তবে সব ভূত কি ছড়ায় তাড়ানো যায়? শাঁকচুন্নি, ব্রহ্মদত্তি — এদের কে তাড়াবে?
একবার ভোলা নামের এক দোকানি দুপুরে মাছের থলি হাতে বাঁশবনের পাশ দিয়ে ফিরছিল। হঠাৎ বাঁশের ডাল থেকে এক মেয়ে সুরে বলে উঠল, “ভোলা, থলিটা রেখে যা, অনেকদিন না খেয়ে আছি।” ভোলা ভয়ে থলিটা ফেলে এক দৌড়ে বাড়ি পালাল। তার বউ, ঝাঁটা হাতে গিয়ে দেখে, শাঁকচুন্নি মহাভোজ সেরে মগডালে দিবানিদ্রায় মগ্ন।
আমার নিজেরও এমন এক অভিজ্ঞতা আছে। দুর্গা বিসর্জনের রাতে আমি পিছিয়ে পড়েছিলাম। সকলেই পুরোহিত মশাইয়ের বাড়িতে ভাঙ খেতে গেছে। বৃষ্টি ঝরছে, রাত গভীর, কিন্তু আমি বেরিয়ে পড়লাম। একা চলতে চলতে সেই বাঁশবনের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ বাজ পড়ার মতো শব্দ, আর এক বিশাল বাঁশ আমার সামনে এসে পড়ে আবার অদ্ভুতভাবে জায়গায় ফিরে যায়। আমি “মাগো!” বলে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যাই পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ির দরজায়। সকলে বলে— বাজ পড়ার শব্দে বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে। কিন্তু আমি আজও ভাবি, ব্যাপারটা কি কাকতালীয় ছিল, না কি অন্য কোনো জগতের ইঙ্গিত?
আমার ছেলেবেলার গল্পে গাছের ভূমিকা ছিল বিশাল। শুধু বাঁশ বা বেলগাছ নয়, ছিল ফলের গাছও — আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, দালিম, সবেদা — আর ফুলের গাছে ছিল স্বর্ণচাঁপা, গন্ধরাজ, বেল। মা বলতেন, দরজা বন্ধ করে রাখো, না হলে বেলফুলের গন্ধে সাপ আসবে! আর স্বর্ণচাঁপা তুলতে পারতেন কেবল পুরোহিত মশাই, কারণ গাছটা ছিল মন্দিরের ছাতে — আমাদের জন্য নিষিদ্ধ।
গ্রীষ্মের দুপুর মানেই ছিল এক গোপন অভিযান। আমাদের এক পিসি ছিলেন, বয়সে প্রায় সমান, কিন্তু দুষ্টুমিতে আমাদের চেয়েও এগিয়ে। দুপুর হতেই আমরা তিনজন চুপিচুপি চলে যেতাম বাড়ির পেছনে এক বিশাল ফলসাগাছে। গাছটা ছিল বিশাল, আর তার ছোট ছোট ফল ছিল টক-মিষ্টি— একেবারে লোভনীয়! পিসি আগে থেকেই গাছে উঠে বসতেন, আর আমরা দুই ভাই তাড়াতাড়ি ফল পেড়ে পকেটে পুরতাম। এদিকে মা আমাদের দেখতে না পেয়ে হৈচৈ শুরু করে ফলসাতলায় হাজির। পিসির নির্দেশে আমরা পাতার আড়ালে একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছিলাম। কাকারা মাকে বলল— “হয়তো পাশের বাড়িতে খেলছে।” মা ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যেয় ঘরে ফিরতেই মা ধমক দিয়ে বললেন, “দাঁড়া, আজ বাবাকে সব বলব। সারাদিন টো টো করে কোথায় থাকিস!” বাবার সামনে ধরা পড়লে রাতে বাইরে খিল দিয়ে দেবে— এমন ভয়েই আমরা বড় হয়েছি। তখন পকেট থেকে ফলসা বার করে মাকে খাইয়ে বলতাম, “দেখো মা, তোমার জন্য এনেছি।” মা মুখে রাগ করলেও, মনের কোণে নরম হয়ে যেতেন। তবু বলতেন, “দুপুরে গাছে চড়িস, যদি ভূতের ঠেলা খেতি তখন বুঝতিস।” তখন আমরা হাসতে হাসতে বলতাম—
“ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি,
রাম-লক্ষণ পাশে আছে, ভয়টা আমার কি!”
আজ সব গাছ হারিয়ে গেছে, পুকুর বুজে গেছে, বাঁশবাগান কেটে বড় বিল্ডিং উঠেছে। কিন্তু আমার ভেতরে এখনও সেই শাঁকচুন্নির ডাক, বাঁশ পড়ার রহস্য, ফলসার রস, আর মায়ের ছড়া— সবকিছুই রয়ে গেছে।
গাছেদের ছায়ায় ঘেরা সেই ছেলেবেলা আজও আমার সঙ্গে হাঁটে— রোদে, বৃষ্টিতে, আর স্মৃতির প্রতিটি বাঁকে।
Comments
Post a Comment