কালীপুজোর রাত এলেই আলোয় রোশনাই এ ভরে ওঠে চারপাশ। আমরা বিশ্বাস করি, আলো দিয়ে শুধু অন্ধকার নয়, ভূতকেও দূরে সরানো যায়। বলা হয়, কালীপুজোর আগের দিন ভূত চতুর্দশীতে আমাদের বংশের পূর্বজরা নাকি ধরাতলে নেমে আসেন, একে একে সিঁড়ি বেয়ে। যদিও কেউ সেটা দেখেনি, তবু গল্পগুলো আমাদের কাছে পৌঁছেছে বাপ-ঠাকুর্দার মুখে মুখে। তাঁদের সময়েই এসব বিশ্বাস আর ভূতের গল্পের রমরমা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই সময়ে বয়স্করা শিশুদের ভয় মিশ্রিত মজার ভূতের গল্প শোনাতেন, আর ছোটরাও আনন্দের সাথে ডুব দিত সেই রূপকথার জগতে। 

আমার বাবা খুব মজা করে ভূতের গল্প বলতে পারতেন, তাই ছোটদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। হরেক রকমের ভূতের সাথে অনায়াস দক্ষতায় হাস্যরস যোগ করতেন। গল্পের ঝুলিতে যেমন থাকতো ব্রহ্মদত্তি আর শাকচুন্নি, তেমনি থাকতো কিঙ্কেবুড়ো নামের (এক কাল্পনিক চরিত্র যিনি বেলগাছের মগডালে থাকতেন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ভূত রূপে) চরিত্রও। বাবা কিঙ্কেবুড়োর মাথায় বেল বেঁধে তাঁকে ছুটিয়ে মারতেন, যেন গল্পের সেই মুহূর্তগুলোতেই ভূত ভয় পেয়ে পালাচ্ছে। আর ঠিক ওই ছোটাছুটির পরের ঘটনাটা কখনো জানা যেত না, কারণ ভূতও ছুটছে আর বাবাও ছুটছে!

আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের ভূতের গল্পগুলো এমনই ছিল—কিছুটা রূপকথা, কিছুটা কল্পনা আর কিছুটা ছিল আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা কিছু ঘটনা থেকে গড়ে ওঠা। এমনই এক বিজয়া দশমীর রাতে এক ঘটনায় আমি নিজেই জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে ঠাকুর বিসর্জনের পর প্রথা অনুযায়ী সবাই পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ি বিজয়া করতে যেতাম। রাতের নির্জনতায় ঝোপঝাড় আর বাঁশঝাড় পেরিয়ে চলেছি। রাস্তা প্রায় দু কিলোমিটার, সাথে টর্চের আলোয় পথ দেখানো এক বৃদ্ধ। দূর থেকে শেয়ালের ডাক শুনে একটু ভয় ভয় লাগছিল, আমি আর আমার এক খুড়তুতো ভাই গল্প করতে করতে অজান্তে কখন যে দলে পিছিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি। বাঁশঝাড়ের কাছে পৌঁছাতেই একটা শেয়ালের তীব্র হুক্কা হুয়া ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরে এলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাঁশঝাড় থেকে আস্ত একটা বাঁশ সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়লো। ভয় পেয়ে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো 'বাবাগো!'।

আলোর আভা একটু দূরে দেখা যেতেই আমরা ছুটলাম আর পুরোহিত মশাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে দেখি, সবাই আমাদের খোঁজে লণ্ঠন হাতে বেরোতে যাচ্ছে। যদিও ঘটনাটা সেদিনের মতো গোপনই রইল, তবু সেই রাতের সেই ভূতুড়ে অনুভূতি যেন এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। এভাবেই আমাদের ছেলেবেলার ভূতের গল্পগুলো বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে ভয় ও মজায় মিলে থাকত।

Comments

Popular posts from this blog