আমাদের বাড়ি কলকাতার কাছে এক মফস্বলে। ছিল গোলাভরা ধান, ছিল পুকুরে মাছ, ছিল একান্নবর্তী পরিবার আর ছিল আমাদের বাড়ির অধিষ্ঠাত্রী ঠাকুর শ্রী শ্রী নন্দ নন্দন মানে শ্রীকৃষ্ণের একটি রূপ। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের কথা আমরা সকলেই জানি তারই মধ্যে একটি নাম আমাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই বাঁদিকে আমাদের মস্ত ঠাকুরঘর আর সেই ঠাকুরঘর কে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন আবর্তিত হতো। বাবার ঘুম যখন ভাঙতো তখনো ভোরের আলো ঠিক মতো ফোটেনি, শিবের স্তোত্র পাঠ শুরু করতেন:
“নমানী শমিশানি নির্বাণ রূপম
নিজ নির্গুনং নির্বিকল্পং নিরীহঙ
বিভূম ব্যাপকং ব্রহ্ম বেদ স্বরুপম
চিদাকাশ ও মাকাশ বাসং ভজেহম”
আমরা তখন বিরক্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি ভোরের আলো ফুটতে বেশ কিছুটা বাকি আছে কিন্তু বাবার ভ্রুক্ষেপ নেই উনি পাঠ করেই চলেছেন:
“চলচ্চিত্র গাত্রম চিদানন্দ মিত্রম
গলে রুদ্র মালং শ্মশানে বসন্তম
নমামী শম্ভূ, শিব শম্ভূ, শিব শম্ভূ”
গুরুগম্ভীর গলায় শিব স্তোত্র পাঠ করেই বাবা বিছানা থেকে উঠে পড়তেন আর ঠিক সেই সময়ই পুরোহিত মশাই ঠাকুর ঘরের দরজা খুলে ঘুম থেকে ঠাকুরকে জাগিয়ে তুলতেন:
“জাগো হো বৃকভানু নন্দিনী ওঠো যুবরাজ”
এমন মধুর কণ্ঠস্বর শুনে আর কি বিছানায় থাকা যায় তাই উঠেই ঠাকুর ঘরে চলে যেতাম আরতির ঘন্টা বাজাতে, কিন্তু মন পড়ে থাকতো কখন ঠাকুরঘরের পেছনের মস্ত বাগানে গতরাতের পড়ে থাকা বেল কুড়োতে যাবো।
একবার বেশ কিছুদিন ধরে বেল কুড়োতে গিয়ে বেলের আর দেখা পাওয়া যায় না। এদিকে বেলের অদর্শনে বাবার আর দাদুর পেটের সমস্যা বেড়েই চলেছে কারণ বেলই ছিল একমাত্র ল্যাক্সেটিভ তখনকার দিনে। এই রহস্যের কিনারা করতে বাবা একটা ফন্দি করে ভোর চারটার সময় বেলগাছে চড়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ একটা লম্বা টিকিওলা ন্যাড়ামাথা যেই না বেলতলায় এলো,প্রায় সাথে সাথেই মাথায় টুক করে একটা বেল ফেলে দিল বাবা সেই চোর বাবাজির ওপর। ভয়ে আর আঘাতে সেই টিকিধারী তো অজ্ঞান। বেগতিক দেখে বাবা এক লাফে গাছ থেকে নেমেই জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো আর সাথে দুষ্টুমি করে একটা বেল চোরের টিকিতে বেঁধে দিল। জ্ঞান ফিরতেই চোর দৌড়ে পালালোর সে কি আপ্রান চেষ্টা। কিন্তু বেল টিকিতে বাঁধা অবস্থায় কি আর ছোটা যায়! যতই সে প্রানপনে পালানোর চেষ্টা করে ততই বেল মাথায় সজোরে আঘাত করে। চোর ভাবল বোধহয় বেলগাছ থেকে ভূতটা মানে ব্রহ্মদৈত্য নেমে এসে টপাটপ মাথায় বেলের বাড়ি দিচ্ছে। কে আছো বাঁচাও, ব্রহ্মদত্তি বলে সে মাথায় আলু নিয়ে পালানোর চেষটা আর তখনই বাবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় "ধর টিকি মার বেল"।
কালের অমোঘ নিয়মে সেই ব্রহ্মদৈত্য আর তার সৃষ্টিকর্তারা কোথায় যে হারিয়ে গেল আর তার সাথে আলো আঁধারির সেই আধিভৌতিক রহস্যময়ী দিনগুলিও।
Comments
Post a Comment