বর্ষণমুখর দিনের গল্প​:

আমার বর্ষাকাল মানে নিজের চোখে দেখা গ্রামবাংলার বর্ষাকাল সেই জল থৈ থৈ মাঠ, পুকুর, কর্দলিপ্ত ফুটবলের বিকেল, জুঁই, বেল এর গন্ধে মাতোয়ারা সন্ধা আর ব্যাঙ এর ডাকে সঘন গহন রাত্রি।সন্ধ্যা হলেই জমাট বাঁধা অন্ধকার ঘিরে ধরতো আমাদের পাড়াকে। আমরা তখন সবাই মিলে ছাদে। প্রকৃতির অকৃত্রিম হাওয়া ই যে গরম থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন। হারিকেনের মিটি মিটি আলো সেই আঁধারের সাথে লড়তে গিয়ে বিষন্ন এক দীপশিখার মত যখন নিভু নিভু ঠিক সেই সম​য় হাজার হাজার জোনাকি দেখা দিত​। জোনাকির আলো আর শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে পরী এসে কখন যে আপন করে নিত। ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি কে আনতে হলে এখনকার যুগে কতই না মেহনত করতে হ​য় কিন্তু সেই সময়ের লাইট ও সাউন্ড সিস্টেম এর কাছে ডাঁহা ফেল​।

প্রথম বর্ষনের পর থেকেই দেখতাম পুকুরের জল কতটা বাড়লো। জল যখন কানায় কানায়​ পরিপুর্ন হ​য়ে রাস্তায় উঠব উঠব করছে সেই পরিপুর্নতায় মনটা খুশিতে ভরে উঠতো। আর জলে ঝাঁপ দেবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘড়ির দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতাম কখন এগারোটা বাজবে। বৃষ্টিতে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা যদিও ডুব সাঁতার ভাল করে না জানার জন্য জলের নিচের রাজ্যটা অধরাই য়ে গেল। একবার হল কি, আমি তখন মাঝগঙগায় (আগে ছিল আদিগঙগা এখন মজে য়েছে পুকুর কিন্তু গঙগা নাম রয়েই গেলো) হঠাৎই মনে হল কে যেন আমাকে টেনে জলের নিচে নিয়ে যাচ্ছে। একে সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে, ঘাট ফাঁকা, কেই বা বাঁচাবে। কিছু আগে একটা জলঢোঁড়া সাপকে পাস দিয়ে সাঁতরে যেতে দেখেছি কিন্তু সে তো আমার থেকেও নিরীহ এক প্রজাতি। তবে কি জলের নিচের অজানা রাজ্য থেকে কোনো রহস্যময়ী প্রানী প্রানপনে পা ছুঁড়তেই প্রানীটি আমাকে ছেড়ে দিল। কোনক্রমে আঁকুপাঁকু করে পাড়ে পৌঁছে দম পুনরুদ্ধার করছি এমন সম পেছন থেকে অট্টহাসির​ শব্দ। চেয়ে দেখি আমার বন্ধু, নাম তার বোলতা যদিও বলার থেকে করাকেই বেশি পছন্দ করে এবং কখন যে অজান্তে ডুবসাঁতারে তার কাজ করে দিয়েছে। 

পুকুর থাকলে বাশবাগান থাকবেই আর দুটোর মাঝামাঝি রাস্তা দিয়ে রাতে একা হেঁটে যেতে অনেক সাহসী লোককেও রাম নাম জপতে দেখেছি। বিশেষত বর্ষাকালে যখন পুকুর জলে ভরে যেত আর একটানা ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাকে প্রকৃতি এক আধিভৌতিক মায়াজাল বিছিয়ে রাখত তখন ঘর থেকেই সেই অনুভুতিগুলো নিতে হত। অবশ্য এর ব্যাতিক্রম হত এবং তার সুবাদে কয়েকবার বিচিত্র অভিজ্গতা লাভ করতে পেরেছি। বর্ষাকালের গ্রামবাংলাররাত মানেই রহস্যঘেরা এক জগত যেখানে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক বা ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শ্রুতিমধুর শব্দ সহজেই  স্বপ্নরাজ্যে পৌঁছে দিত। এমনই এক বর্ষার রাতে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। রাত তখন প্রায় এগারোটা অথচ বাবা বাড়ি ফেরেননি। মা উৎকন্ঠা চেপে রাখতে না পেরে আমাকে পাশের পাড়ায় বন্ধুর বাড়িতে খুঁজে সতে বললেন। বাইরে থেকে থেকেই বিদ্যুত চমকাচ্ছে সাথে মেঘ গর্জন। কিন্তু উপায় নেই অগত্যা রাম নাম করতে করতে হাতে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়াঅন্য পাড়াতে যেতে হলে পুকুর পাড়ের একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে প্রায় একশ মিটার যেতে হবে। সেই জায়্গায় এসে মনে পড়ল আরে এখানেই তো পুকুরপাড়ে সেই বুড়িটা থাকত কিছুদিন আগে যে মারা গেল। য়ে হাত পা হিম য়ে আসছে কিন্তু যেতেই হবে ভেবে জোরে জোরে রাম নাম করতে করতে যেই না পা বাড়ানো ওমনি মনে হল শুনতে পেলাম সাবধান বানী " বাড়ি যা, এক পা এগোলে কপালে দুর্ভোগ আছে"। আত্মারাম খাঁচাছাড়া, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এক ছুটে সোজা বাড়িতে গিয়ে নিশ্বাস ফেললাম। বাড়িতে এসে দেখি বাবা মস্ত একটা দু কেজি মাছ নিয়ে আগেই হাজির। মুখে কি পরিতৃপ্তির হাসি অনেক দিন পরে আজ টোপ গিলেছে মাছ বাবাজি। পরের দিন সকালে স্কুল যাবার রাস্তায় দেখলাম বৃষ্টিতে আমাদের আর পাশের পুকুর এক য়ে গেছেকিছু মাছ এক পুকুর থেকে আর এক পুকুরে যাচ্ছে রাস্তার ওপর দিয়ে দুপাড়ার মাঝামাঝি নিচু এলাকাতে কোমর সমান জলঅনেকে বলাবলি করছে রাতে নাকি আরো ছিল! কি ভাগ্যি আমি আগে যাই নি, তবে কি তবে কি বুড়িটা সেই বার্তা দিতে চেয়েছিলতবে কি সেই সম এমন কিছু অদৃশ্য শক্তি আভাস পেয়েছিলাম​

এবার আর একটি ঘটনা বলি। আমাদের বাড়িতে দুর্গাঠাকুর বিসর্জনের পর রীতি ছিল সবাই দলবেঁধে পুরোহিতের বাড়ি সিদ্ধি খেতে যাওয়া। একবার আমি অন্য ঠাকুর বিসর্জন দেখতে গিয়ে দেরি হওয়ায় বাড়ির বড়রা চলে গেছেন্। বর্ষার রাত একটু বৃষ্টি পড়ছে, যদি না যাই সব আনন্দ মাটি। ওনাদের বাড়ি যেতে এক বিশাল বাঁশ গাছ ভরা জঙ্গল এর ভিতর দিয়ে যেতে হয়। যেইমাত্র ওখানে ঢুকেছি ওমনি বাজ পড়ার শব্দ আর একটা বাঁশ সজোরে আমার সামনে পড়লো আবার স্ব্স্থানে চলে গেল। আমি মাগো বলে চিৎকার করতে করতে এক্কেবারে পুরোহিত মশাইএর বাড়ির দোরগোরায়। অনেকেই বললো আহারে বাজ পড়ার শব্দে ছেলেটা কি ভয়টাই না পেয়েছে। ওকে একা একা আসতে দেওয়া মোটেই উচিত হয়নি। আমি আমার ছোট্টো বুদ্ধিতে সেদিন বুঝতে পারিনি ঘটনাগুলো কি সত্যি কাকতালীয় নাকি অন্য কোনো জগতের অস্তিত্বের আভাস ছিল। তবে এখন বুঝতে পারি যে তিনিই আপদে বিপদে বিশ্বাসী মানুষদের​ সঠিক পথ দেখাতেন। 




Comments

Popular posts from this blog